অ্যাপ বানাতে ১৪৬ কোটি, গেম খেলেই শেষ! আইসিটি প্রকল্পে অনিয়মের ছড়াছড়ি

ict projects corruption

তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) খাতে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাস্তবায়িত ২১টি প্রকল্পে অপ্রয়োজনীয় খাতে বিপুল অর্থ ব্যয়ের অভিযোগ উঠেছে। একটি প্রকল্পে ১৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি করা হয় ১৬৪টি মোবাইল গেম ও ১০২টি অ্যাপ, যেগুলোর ব্যবহার বা কার্যকারিতা নেই বললেই চলে। তদন্তে উঠে এসেছে, প্রকল্পের আওতায় এই গেম-অ্যাপগুলো তৈরি করেছে বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, সরকারের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে এগুলো তৈরি হয়নি।

এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত একটি ১২ সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে। কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন বর্তমান বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান।

অ্যাপ-গেম বানাতে ৩৩০ কোটি, অপচয় ১৪৬ কোটিরও বেশি

২০১৬ সালে ‘মোবাইল গেম ও অ্যাপ্লিকেশনস ডেভেলপমেন্ট’ প্রকল্প নেয় সরকার, যার ব্যয় ধরা হয় ৩৩০ কোটি টাকা। এ প্রকল্পের আওতায় ১৬৪টি মোবাইল গেম ও ১০২টি মোবাইল অ্যাপ তৈরি করা হয়। তদন্ত কমিটির মতে, এই গেম-অ্যাপগুলো বাস্তবিক অর্থে কার্যকর নয় এবং সেগুলোর কোনো ব্যবহারিক ফল পাওয়া যায়নি।

কমিটি বলছে, এই খাতে কমপক্ষে ১৪৬ কোটি টাকা অপচয় হয়েছে, যেগুলো স্রেফ ঠিকাদারদের কাছ থেকে প্যাকেজ আকারে কেনা হয়েছে। এরমধ্যে কোনো গবেষণা, বাজার বিশ্লেষণ, কিংবা সরকার পরিচালিত মান যাচাইয়ের প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি।

জমি-ভবনে অযথা ব্যয়: সাততলার ভবন যেখানে দরকার দুই তলা

একই রকম অনিয়ম পাওয়া গেছে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে। আটটি জেলায় ‘আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার’ নির্মাণে ৫৩৪ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। প্রতিটি কেন্দ্রে ছয়তলা ভবন নির্মাণ করা হলেও প্রকৃতপক্ষে দুই তলার ভবনই যথেষ্ট ছিল। এই বাড়তি নির্মাণ ব্যয়ে অপচয় হয়েছে আরও ১১০ কোটি টাকা।

তদন্ত কমিটি জানিয়েছে, এসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকলেও সেখানে প্রশিক্ষক বা জনবল নেই। ভবন থাকা সত্ত্বেও কার্যকর প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় কেন্দ্রগুলোর ভবিষ্যৎ ব্যবহার নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।

‘হাসিনা অ্যান্ড ফ্রেন্ডস’ ওয়েবসাইটে ১৮ কোটি টাকা ব্যয়

২০১৬ সালে নেওয়া হয় ৪৪৩ কোটি টাকার ‘উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন একাডেমি প্রতিষ্ঠা (আইডিয়া)’ প্রকল্প। এর আওতায় “www.hasinaandfriends.gov.bd” নামের একটি ওয়েবসাইট তৈরি করতে খরচ হয় প্রায় ১৮ কোটি টাকা। তবে ওয়েবসাইটটি বর্তমানে নিষ্ক্রিয়। তদন্ত কমিটি মনে করে, এই প্রকল্পের ব্যয় ছিল অপ্রয়োজনীয় এবং অনিয়মজনিত।

বিডিজবস-এর সিইও এ কে এম ফাহিম মাশরুর মন্তব্য করেন, ‘‘এমন একটি ওয়েবসাইট তৈরি করতে সর্বোচ্চ এক-দুই কোটি টাকার প্রয়োজন হয়। এখানে ব্যয়ের যৌক্তিকতা নেই।’’

‘বিনিময়’ পেমেন্ট গেটওয়ের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন

আইডিয়া প্রকল্পের আওতায়ই তৈরি করা হয় ডিজিটাল লেনদেন প্ল্যাটফর্ম বিনিময়, যেখানে ব্যয় করা হয় ৬৫ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত এই পেমেন্ট গেটওয়ে বাস্তব অর্থে কার্যকর হয়নি। এর মধ্যে খরচ হয়েছে ৪৪ কোটি টাকা, অবশিষ্ট ২১ কোটি টাকা ফেরত নেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিটি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘‘এই প্ল্যাটফর্মটি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের শেল কোম্পানির উদ্যোগে করা হয়েছিল।’’ তাঁর মতে, এটিকে বাংলাদেশ ব্যাংক বা ব্যাংকিং কর্তৃপক্ষের অধীনে না দিয়ে আইসিটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে দেওয়া হওয়ায় কার্যক্রম এগোয়নি।

২১টি প্রকল্পে ৭ হাজার কোটি টাকার সাশ্রয়ের সম্ভাবনা

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে দেখা যায়, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বর্তমানে ও পূর্ববর্তী সময়ে চলমান ২১টি প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয় ১৯ হাজার ২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অপ্রয়োজনীয় খাত বাদ দিলে ৬ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব।

কোনো কোনো প্রকল্পে এমন কিছু কাজ রাখা হয়েছে যেগুলো আইসিটি বিভাগের আওতায় পড়ে না, আবার কিছু প্রকল্পে উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য নেই এমন কার্যক্রম যুক্ত করা হয়েছে।

আইসিটি বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী জানান, ‘‘অনিয়ম থাকায় প্রতিবেদনটি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী কিছু প্রকল্প স্থগিত করা হয়েছে।’’

বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু প্রকল্প গ্রহণে নয়—ব্যয়ের যৌক্তিকতা, বাস্তবায়ন দক্ষতা ও ফল পরিমাপেও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন। নাহলে বড় বাজেটেও কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলবে না।