আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ ইতিহাস: ১৯৩০ থেকে ২০২২

Argentina World Cup history

আর্জেন্টিনা ফুটবল দল মানেই আবেগ, ঐতিহ্য, ও গর্বের ইতিহাস। ফুটবল বিশ্বকাপে এই দলটির যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৩০ সালে। এরপর কেটে গেছে প্রায় এক শতাব্দী, যার মধ্যে আছে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব, আবার হতাশার কালো অধ্যায়ও। ২০২২ সালে মেসির নেতৃত্বে তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জিতে আর্জেন্টিনা আবারও প্রমাণ করেছে—এই দল শুধু মাঠে নয়, হৃদয়েও রাজত্ব করে।

চলুন এক নজরে দেখে নিই ১৯৩০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ অভিযানের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলো।

১৯৩০: শুরুর বিশ্বকাপে রানার্স-আপ

১৯৩০ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথম আসর অনুষ্ঠিত হয় উরুগুয়ে, এবং এটি ছিল ফুটবল ইতিহাসের এক অমূল্য মাইলফলক। আর্জেন্টিনা, যেটি ফুটবলের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, এই প্রথম বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেছিল এবং তারা চমকপ্রদ পারফরম্যান্সের মাধ্যমে ফাইনালে পৌঁছাতে সক্ষম হয়।

বিশ্বকাপের প্রথম আসরে মোট ১৩টি দল অংশগ্রহণ করেছিল, যার মধ্যে আর্জেন্টিনা ছিল একটি প্রধান ফেবারিট। তারা গ্রুপ পর্বে দুর্দান্ত খেলে এবং বিভিন্ন শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে হারিয়ে ফাইনালে পৌঁছে। আর্জেন্টিনার দলের প্রতিভা এবং তাদের ফুটবল খেলার কৌশল বিশ্বকে আস্থা দিয়েছিল যে তারা এই প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের জন্য প্রস্তুত।

ফাইনালে আর্জেন্টিনা এবং উরুগুয়ের মধ্যে লড়াইটি ছিল ঐতিহাসিক। উরুগুয়ে ছিল এই টুর্নামেন্টের আয়োজক দেশ, এবং তাদের দলও ছিল শক্তিশালী। ফাইনালে আর্জেন্টিনা এবং উরুগুয়ে মুখোমুখি হলে, উরুগুয়ে তাদের মাঠের সুবিধা এবং বাড়তি উদ্দীপনার মাধ্যমে ৪-২ গোলে জয় লাভ করে।

এটি ছিল বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম ফাইনাল ম্যাচ, এবং উরুগুয়ের ঐতিহাসিক জয় একটি স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে ওঠে। তবে আর্জেন্টিনার জন্য এই ম্যাচটি ছিল একটি গর্বিত দিক, কারণ তারা বিশ্বকাপের প্রথম আসরেই রানার্স-আপ হয়ে নিজেদের অবস্থান প্রতিষ্ঠা করেছিল। বিশ্বকাপের প্রথম আসরটি আর্জেন্টিনার ফুটবল ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিল, এবং সেই থেকে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ যাত্রা শুরু হয়।

🔹 ফলাফল: রানার্স-আপ
🔹 বিশেষত্ব: এটি ছিল বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম ফাইনাল ম্যাচ।

১৯৭৮: প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন

১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপ ছিল আর্জেন্টিনার জন্য এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত, কারণ এটি ছিল তাদের প্রথম বিশ্বকাপ জয়। ঘরের মাঠে অনুষ্ঠিত এই বিশ্বকাপে, আর্জেন্টিনা দলের কোচ ছিলেন সিজার লুইস মেনোত্তি, যিনি দলের মধ্যে শক্তিশালী কৌশল এবং একত্রিত মনোভাব গড়ে তোলেন। এই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা এমন একটি দল হিসেবে আবির্ভূত হয়, যা পুরো বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীদের কাছে এক নতুন শক্তির প্রতীক হয়ে ওঠে।

ফাইনালে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ছিল নেদারল্যান্ডস, যারা শক্তিশালী দল হিসেবে পরিচিত ছিল। ম্যাচটি ছিল উত্তেজনায় ভরা, তবে আর্জেন্টিনা তাদের ঘরের মাঠের সুবিধা এবং শ্রেষ্ঠত্বকে কাজে লাগিয়ে ৩-১ ব্যবধানে জয় লাভ করে। আর্জেন্টিনার এই জয় শুধুমাত্র একটি ফুটবল কৃতিত্ব ছিল না, বরং এটি দেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক গৌরবের মুহূর্ত ছিল, যা আর্জেন্টিনার ফুটবল ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

মারিও কেম্পেসের অবদান এই বিশ্বকাপে ছিল অপরিসীম। কেম্পেস আর্জেন্টিনার আক্রমণভাগের প্রধান মুখ ছিলেন, এবং তিনি তার দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের মাধ্যমে দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ গোল করছিলেন। বিশেষ করে ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে তার দুইটি গোল ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে, কেম্পেস এই টুর্নামেন্টে মোট ৬ গোল করে গোল্ডেন বুট জয়ের গৌরব অর্জন করেন। তার এই অসাধারণ পারফরম্যান্স এবং অবদান আর্জেন্টিনার প্রথম বিশ্বকাপ জয়ে বড় ভূমিকা রাখে।

🔹 ফাইনাল: আর্জেন্টিনা ৩–১ নেদারল্যান্ডস
🔹 ফলাফল: চ্যাম্পিয়ন
🔹 কিংবদন্তি: মারিও কেম্পেস (গোল্ডেন বুট জয়ী)

১৯৮৬: ম্যারাডোনার যুগ এবং ‘হ্যান্ড অফ গড’

১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপ আর্জেন্টিনার জন্য একটি স্বর্ণালী অধ্যায় হয়ে রইল, বিশেষ করে দলের অধিনায়ক ডিয়েগো ম্যারাডোনার অসাধারণ নেতৃত্বে। ম্যারাডোনা ছিলেন পুরো টুর্নামেন্টের প্রাণ। তার অসাধারণ পারফরম্যান্স, বিশেষত ‘হ্যান্ড অফ গড’ গোল এবং ‘Goal of the Century’ আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হতে সাহায্য করে।

‘হ্যান্ড অফ গড’ গোল: ম্যাচের ৫১ মিনিটে ম্যারাডোনা বলটি হাতে ঠেলে জালপাশে পাঠান, যেটি রেফারির নজরে পড়ে না এবং গোল হিসেবে গণ্য হয়। এটি ছিল বিতর্কিত, কিন্তু বিশ্বকাপ ইতিহাসে একটি চিরস্থায়ী স্মৃতি হয়ে যায়।

‘Goal of the Century’: এর বিপরীতে, ম্যারাডোনা একেবারে অসাধারণ একটি গোল করেছিলেন—অতিরিক্ত ১০ মিনিটে ৬ জন ইংলিশ খেলোয়াড়কে কাটিয়ে গোল করেছিলেন। এটি এখনও পর্যন্ত বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত গোল হিসেবে বিবেচিত।

ফাইনালে আর্জেন্টিনা ৩-২ গোলে পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। ম্যারাডোনার অবদান ছিল অবিস্মরণীয়, এবং তিনি বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ সম্মান গোল্ডেন বলও অর্জন করেন।

🔹 ফাইনাল: আর্জেন্টিনা ৩-২ পশ্চিম জার্মানি
🔹 ম্যারাডোনার গোল: ৫ গোল, ৫ অ্যাসিস্ট

১৯৯০: দ্বিতীয় রানার্স-আপ – হতাশার ফাইনাল

১৯৯০ সালের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার যাত্রা ছিল দীর্ঘ, তবে শেষ পর্যন্ত হতাশাজনক পরিণতি ঘটেছিল। এই বিশ্বকাপটি ছিল ডিয়েগো ম্যারাডোনার নেতৃত্বে আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় ফাইনাল। আর্জেন্টিনা পুরো টুর্নামেন্টে শক্তিশালী দল হিসেবে পরিচিত ছিল, তবে ফাইনালে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ—পশ্চিম জার্মানি।

ফাইনালে আর্জেন্টিনা ১-০ গোলে পরাজিত হয় পশ্চিম জার্মানির কাছে, একটি বিতর্কিত পেনাল্টি শটে। আর্জেন্টিনার কোচ এবং খেলোয়াড়রা বিশ্বাস করেছিলেন যে রেফারিং সিদ্ধান্ত তাদের বিপক্ষে ছিল, যা ম্যাচের ফলাফলে প্রভাব ফেলেছিল। এর ফলে আর্জেন্টিনা দ্বিতীয়বারের মতো রানার্স-আপ হয় এবং তাদের বিশ্বকাপ স্বপ্ন অধরা থেকে যায়।

🔹 ফাইনাল: আর্জেন্টিনা ০–১ পশ্চিম জার্মানি
🔹 বিতর্ক: বিতর্কিত পেনাল্টির সিদ্ধান্ত
🔹 ফলাফল: রানার্স-আপ

২০০২: প্রত্যাশার বিপরীতে পতন

২০০২ সালের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা ছিল ফেবারিট হিসেবে ধরা হলেও, এই টুর্নামেন্টটি ছিল তাদের জন্য এক ভীষণ হতাশাজনক অভিজ্ঞতা। গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা, জাভিয়ের জানেত্তি, এবং অন্যান্য তারকা খেলোয়াড়দের উপস্থিতি সত্ত্বেও আর্জেন্টিনা গ্রুপ স্টেজ থেকে বাদ পড়ে। এটি ছিল অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত, কারণ তাদের দলটি সেরা ফর্মে ছিল এবং সারা বিশ্ব তাদের নিয়ে অনেক বড় প্রত্যাশা করেছিল।

এই প্রতিযোগিতায় আর্জেন্টিনার বাজে পারফরম্যান্স তাদের পতন ঘটায় এবং তারা বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো বড় ধরনের অপমানের সম্মুখীন হয়। আর্জেন্টিনা ২০০২ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জয়গুলো পেতে ব্যর্থ হয় এবং গ্রুপে তৃতীয় হয়ে বিদায় নেয়।

🔹 ফলাফল: গ্রুপ স্টেজে বাদ
🔹 আঘাত: ইতিহাসের অন্যতম বাজে পারফরম্যান্স

২০১৪: মেসির নেতৃত্বে ফের ফাইনালে যাত্রা

২০১৪ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার জন্য একটি নতুন সুযোগ ছিল। লিওনেল মেসির নেতৃত্বে আর্জেন্টিনা দুর্দান্তভাবে প্রতিযোগিতায় ফিরে আসে। মেসি টুর্নামেন্টের একনিষ্ঠ নেতা হিসেবে দলের সাফল্যের মূল কারণ হয়ে ওঠে। তিনি তার অসাধারণ পারফরম্যান্সে আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে নিয়ে যান।

ফাইনালে আর্জেন্টিনা মুখোমুখি হয় জার্মানির সাথে। ম্যাচটি ছিল অত্যন্ত রোমাঞ্চকর, কিন্তু অতিরিক্ত সময়ের গোলের কারণে আর্জেন্টিনা ১-০ গোলে পরাজিত হয়। মেসির অসাধারণ পারফরম্যান্স এবং গোলগুলো সত্ত্বেও আর্জেন্টিনা জয় লাভ করতে পারেনি।

মেসি এই টুর্নামেন্টে গোল্ডেন বল জয় করেন এবং তার অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য সমালোচকদের প্রশংসা লাভ করেন।
🔹 ফাইনাল: আর্জেন্টিনা ০–১ জার্মানি (অতিরিক্ত সময়ে)
🔹 মেসির অবদান: গোল্ডেন বল জয়
🔹 ফলাফল: রানার্স-আপ

২০২২: মেসির স্বপ্ন পূরণ – তৃতীয় বিশ্বকাপ জয়

২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপ ছিল আর্জেন্টিনার জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। এই বিশ্বকাপটি ছিল লিওনেল মেসির জন্য স্বপ্ন পূরণের দিন, কারণ তিনি তার দীর্ঘ ক্যারিয়ারের সেরা অর্জন লাভ করেন। যদিও আর্জেন্টিনা সৌদি আরবের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে হারিয়েছিল, তারপর তারা ঘুরে দাঁড়িয়ে দুর্দান্তভাবে বিশ্বকাপের শিরোপা ঘরে নিয়ে আসে।

ফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল ফ্রান্স, এবং এটি ছিল একটি উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচ। ম্যাচটি ৩-৩ গোলে সমতায় শেষ হওয়ার পর টাইব্রেকারে আর্জেন্টিনা ৪-২ ব্যবধানে জয়ী হয়। মেসির নেতৃত্বে আর্জেন্টিনা এই বিশ্বকাপ জয়ের পর দেশটির ফুটবল ইতিহাসে নতুন এক দিগন্ত সূচনা হয়।

মেসি এই বিশ্বকাপে ৭ গোল এবং ৩ অ্যাসিস্ট করেন এবং গোল্ডেন বল জয় করেন, যা তার অবদান এবং দৃষ্টিকোণকে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। ২০২২ বিশ্বকাপ জয় আর্জেন্টিনার ফুটবল ইতিহাসে এক চিরকালীন স্মৃতি হয়ে থাকবে।

🔹 ফাইনাল স্কোর: ৩-৩ (৪-২ টাইব্রেকারে)
🔹 মেসির পরিসংখ্যান: ৭ ম্যাচে ৭ গোল, ৩ অ্যাসিস্ট
🔹 বিশ্ব জয়: তৃতীয়বার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন (1978, 1986, 2022)

আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ ইতিহাসের পরিসংখ্যান:

আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ: ১৯৩০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত ১৭টি বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা অংশগ্রহণ করেছে।
চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সংখ্যা: ৩ বার (১৯৭৮, ১৯৮৬, ২০২২)
রানার্স-আপ: ৩ বার (১৯৩০, ১৯৯০, ২০১৪)
গোল: আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়রা বিশ্বকাপে অসংখ্য গোল করেছে, যার মধ্যে ম্যারাডোনা, মেসি, কেম্পেস, বাতিস্তুতা অন্যতম।
ফাইনালে উপস্থিতি: ৫ বার (১৯৩০, ১৯৭৮, ১৯৮৬, ১৯৯০, ২০১৪)

বিশ্বকাপ ইতিহাসে আর্জেন্টিনার কিংবদন্তি ফুটবলাররা:

  • ডিয়েগো ম্যারাডোনা: আর্জেন্টিনার ফুটবল ঈশ্বর, ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন। তার অসাধারণ নেতৃত্ব এবং গেমের জ্ঞান আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ শিরোপা এনে দেয়।
  • লিওনেল মেসি: আধুনিক যুগের ম্যারাডোনা, ২০২২ সালের বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন এবং গোল্ডেন বল জয়ী।
  • মারিও কেম্পেস: ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপ জয়ী এবং গোল্ডেন বুট জয়ী।
  • গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা: আর্জেন্টিনার ফুটবলের কিংবদন্তি এবং বিশ্বকাপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী।