মাত্র তিন মাসে ১.১৮ লাখ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতি বেড়েছে ২০ ব্যাংকে

1.18 lakh crore taka increased in 20 banks in just three months

বাংলাদেশের ব্যাংক খাত এক ভয়াবহ সংকটে পড়েছে। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে ২০টি রুগ্ন ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকায়, যা আগের প্রান্তিকে ছিল ৫৩ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ, তিন মাসে ঘাটতি বেড়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা। এই তথ্য উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ব্যাংক খাতের মোট মূলধন ঘাটতি এখন ১ লাখ ১৭ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা। কিছু ব্যাংকে মূলধন উদ্বৃত্ত থাকলেও রুগ্ন ব্যাংকগুলোর দুরবস্থার কারণে সামগ্রিক চিত্র ভয়াবহ হয়ে উঠেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ঘাটতির পেছনে রয়েছে বছরের পর বছর ধরে চলা অব্যবস্থাপনা, ঋণের নামে লুটপাট ও রাজনৈতিক প্রভাবের অপব্যবহার। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় (২০০৯–২০২৪) ব্যাংক খাতের রুগ্ন দশা ক্রমেই প্রকট হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, গত ১৫ বছরে অন্তত পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে এসব ব্যাংক থেকে।

কোন কোন ব্যাংকে কেমন ঘাটতি?
ডিসেম্বর ২০২৪ শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি সবচেয়ে বেশি—৫২ হাজার ৮৯১ কোটি টাকা। এরপর রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (১৮,১৯৯ কোটি), ইউনিয়ন ব্যাংক (১৫,৬৯০ কোটি), ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক (১৩,৯৯১ কোটি), ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ (১২,৮৮৫ কোটি), সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (১১,৭০৯ কোটি), আইএফআইসি ব্যাংক (৯,০২৯ কোটি) ও ন্যাশনাল ব্যাংক (৭,৭৯৯ কোটি)।

এছাড়া রূপালী, পদ্মা, অগ্রণী, বেসিক, গ্লোবাল ইসলামী, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন, আইসিবি ইসলামিক, স্ট্যান্ডার্ড, বাংলাদেশ কমার্স, এবি ব্যাংক, আল আরাফাহ ও হাবিব ব্যাংকসহ ২০টি ব্যাংকের সবকটিই বিশাল ঘাটতির মুখে পড়েছে।

ঘাটতির প্রভাব কী?
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতের সম্মিলিত সিআরএআর (Capital to Risk-weighted Asset Ratio) নেমে এসেছে ৩.০৮ শতাংশে, যা সেপ্টেম্বরে ছিল ৬.৮৬ শতাংশ। অথচ ব্যাসেল-৩ নীতিমালা অনুসারে প্রতি ব্যাংকের এ অনুপাত ১০ শতাংশের নিচে নামা উচিত নয়।

মূলধন ঘাটতির কারণে এসব ব্যাংক লভ্যাংশ দিতে পারছে না, নতুন ঋণ বিতরণেও অক্ষম হয়ে পড়ছে। এমনকি গ্রাহকদের আস্থা কমে যাওয়ায় আমানত টানাও বাড়ছে। বিদেশি ব্যাংকগুলো বাংলাদেশের ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেনে সতর্কতা অবলম্বন করছে, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

খেলাপি ঋণ ও অবলোপনের উদ্বেগজনক চিত্র
২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, যা এক বছরে বেড়েছে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা। একই সময়ে ঋণ অবলোপন হয়েছে ৮১ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকার, যা আগের বছরের তুলনায় ৯,৭৬১ কোটি টাকা বেশি। এছাড়া পুনঃতফসিল করা হয়েছে আরও ৩ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ।

বিশেষজ্ঞদের মতামত
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন জানান, উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণে প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হচ্ছে ব্যাংকগুলো। তিনি বলেন, “মূলধন ঘাটতি হলে ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়, গ্রাহক হারানোর আশঙ্কা বাড়ে এবং বিদেশি অংশীদাররাও সতর্ক হয়ে যায়।”

অন্যদিকে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ জানান, “গত ১৫ বছরে সরকারের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে দেশের অর্ধেক ব্যাংক বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। কিছু ব্যাংক এমন অবস্থায় আছে যে, তারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়মিত বেতন দিতে পারছে না।”