ফিলিস্তিনি সাংবাদিক সালেহ আল-জাফারাওয়ি ২০১৮ সালে “গ্রেট মার্চ অব রিটার্ন” আন্দোলনের সময় একজন স্বাধীন সাংবাদিক ও আলোকচিত্রশিল্পী হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে অবদান রাখতেন এবং সামাজিক মাধ্যমে গাজার বাস্তব চিত্র তুলে ধরতেন।
২০২৩ সালে যুদ্ধ শুরু হলে, সালেহ তার ক্যামেরা হাতে নিয়ে গাজার প্রতিটি ধ্বংসস্তূপ, বোমাবর্ষণ ও গণহত্যার দৃশ্য নথিভুক্ত করতে শুরু করেন। তার তোলা ভিডিও ও ছবি ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। ইনস্টাগ্রামে তার অনুসারীর সংখ্যা ১ কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তবে ইসরায়েলি অপরাধের নথিপত্র প্রকাশ করায় তার অ্যাকাউন্ট একাধিকবার স্থগিত করা হয়।
গণহত্যার মাঝেও সত্যের প্রতি অটল
তার ক্যামেরার লেন্সে ধরা পড়েছিল ইসরায়েলের গণহত্যার নির্মম বাস্তবতা। তিনি নির্ভয়ে বোমা হামলার স্থানে ছুটে যেতেন, আহতদের উদ্ধার করতেন এবং বিশ্বকে জানাতেন কী ঘটছে গাজার ভেতরে।
যুদ্ধের মাঝেও তার জীবনে ছিল ব্যক্তিগত দুঃখ ও সংগ্রাম। তার মা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য গাজা ছাড়তে বাধ্য হন। বড় ভাই নাজি আল-জাফারাওয়িকে আল-শিফা হাসপাতাল থেকে ইসরায়েলি সেনারা অপহরণ করে নিয়ে যায়। অসুস্থ বাবার দেখাশোনার দায়িত্ব পড়ে সালেহর ওপর। পরিবারের যত্ন আর সাংবাদিকতার দায়িত্ব—দু’টোই তিনি সমানভাবে পালন করতেন।
লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়া
তার জনপ্রিয়তা বাড়তেই ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ তাকে লক্ষ্যবস্তু বানায়। আগের মতোই তারা হুমকি দিতে শুরু করে—যেভাবে তারা সাংবাদিক আনাস আল-শরীফ, ইসমাইল আল-ঘুল, ও হাসান ইসলাইহকে হত্যা করেছিল।
তার শেষ দিকের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি নিজের প্রেস ভেস্ট খুলে এক শিশুর গায়ে পরিয়ে দেন এবং বলেন—
“আমরা যদি মারা যাই, এই শিশুরাই আমাদের জায়গা নেবে। কারণ এই মাটিই আমাদের, এবং আমরা এর জন্যই বাঁচি।”
যুদ্ধবিরতির রাতে সালেহ আনন্দে ভরা একটি ভিডিও প্রকাশ করেন। তিনি বলেছিলেন, “অবশেষে শান্তি ফিরেছে।” তার পরিবার দীর্ঘদিন পর কিছুটা স্বস্তি অনুভব করেছিল। তারা ভেবেছিল, বিপদ হয়তো কেটে গেছে।
কিন্তু সালেহ থেমে যাননি। যুদ্ধবিরতির পরও তিনি মাঠে ছিলেন, খবর সংগ্রহ করছিলেন। কারণ ইসরায়েলি বাহিনী পিছু হটলেও তাদের রেখে যাওয়া সশস্ত্র মিলিশিয়ারা তখন গাজায় বিশৃঙ্খলা ছড়াচ্ছিল।
আল-সাবরা এলাকায় যখন প্রতিরোধযোদ্ধাদের সঙ্গে ওই মিলিশিয়াদের সংঘর্ষ শুরু হয়, সালেহ সেখানে খবর কাভার করছিলেন। সেখানেই তাকে অপহরণ, নির্যাতন ও সাতবার গুলি করা হয়, বলে জানিয়েছে স্থানীয় সূত্রগুলো।
এই খবর তার পরিবারের কাছে বজ্রাঘাতের মতো পৌঁছায়। অসুস্থ বাবার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। বড় ভাই নাজি বন্দি বিনিময়ের অংশ হিসেবে মুক্তি পান, কিন্তু ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন।
সালেহর হত্যার খবর গাজার সাংবাদিক মহলে গভীর শোকের সৃষ্টি করে। সহকর্মীরা তাকে স্মরণ করেন, যেমন তারা এর আগে নিহত সাংবাদিকদের করেছিলেন।
সালেহর হত্যাকাণ্ড শুধু আরেকজন সাংবাদিকের মৃত্যু নয়—এটি এক সতর্ক সংকেত। যুদ্ধবিরতির পরও গাজার সাংবাদিকরা নিরাপদ নন। ইসরায়েলি সেনারা হয়তো পিছু হটেছে, কিন্তু তাদের ছায়া এখনো গাজায় ভাসছে—মিলিশিয়াদের মাধ্যমে তারা তাদের যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।
“সালেহর হত্যার বার্তা পরিষ্কার—যে কেউ গাজার সত্য তুলে ধরবে, ইসরায়েলের ধ্বংসযজ্ঞের কথা বলবে, তাকে থামিয়ে দেওয়া হবে।”
সালেহ আল-জাফারাওয়ির হত্যার মধ্য দিয়ে গাজায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা ২৭০-এর বেশি হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো একে ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী যুদ্ধ বলে উল্লেখ করেছে সাংবাদিকদের জন্য।
বিশ্বজুড়ে সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীরা সালেহের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন—একজন সত্যিকারের কণ্ঠস্বর, যিনি নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন:
“কলমের শক্তি বুলেটের চেয়েও শক্তিশালী।”