তপ্ত রোদে পুড়ছে ইতালির লাম্পেদুসা দ্বীপ। ফুটবল মাঠে স্থানীয় শিশুরা খেলায় মেতে আছে, তাদের আনন্দমুখর কণ্ঠে মুখর চারদিক। কিন্তু মাঠের এক কোণে ছায়ায় বসে থাকা কয়েকজন তরুণের চোখে নেই সেই আনন্দ। তাদের চোখে ভাসছে স্মৃতির বেদনা আর বেঁচে ফেরার বিস্ময়।
তাদের একজন বাংলাদেশের কিশোর রহিম*। বয়স মাত্র ১৭। ভূমধ্যসাগরের ভয়াল ঢেউ পেরিয়ে এখানে পৌঁছেছেন মাসখানেক আগে।
বাংলাদেশের ছোট্ট গ্রাম থেকে শুরু
রহিমের বেড়ে ওঠা মাদারীপুর জেলার কালিকাপুর গ্রামে। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া এই কিশোরের স্বপ্ন ছিল বাবাকে সাহায্য করা আর ছোট দুই ভাইয়ের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা।
২০২৪ সালের ৩ মার্চ সেই স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরেই শুরু হয় তার অনিশ্চিত যাত্রা। প্রথমে ঢাকা থেকে দুবাই, সেখান থেকে মিশরের আলেকজান্দ্রা। সেখানেই পাচারকারীরা তাকে আটকে রাখে কয়েকদিন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সীমান্ত সুরক্ষা সংস্থা ফ্রন্টেক্স নিশ্চিত করেছে—বাংলাদেশ থেকে লিবিয়ায় যাওয়ার অন্যতম ট্রানজিট পয়েন্ট হলো এই আলেকজান্দ্রা।
নরক হয়ে ওঠা লিবিয়া
লিবিয়ায় পৌঁছানোর পরই রহিম বুঝতে পারেন কী ভয়ঙ্কর বাস্তবতার মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন তিনি। প্রথমে ত্রিপোলির একটি ঘরে বন্দি রাখা হয়। কয়েকদিন পর সাব্রাথায় স্থানান্তর। সেখানে শুরু হয় নির্যাতনের নতুন অধ্যায়।
“আমাদের ছোট একটি ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল। খাবার দিত না, মারধর করতো। ভিডিও কল দিয়ে পরিবারের কাছে মুক্তিপণ চাইতো।”
রহিম বলেন, পাচারকারীরা তার পরিবারের কাছে এক হাজার ইউরো দাবি করে। দিতে না পারায় তাকে ভয়ঙ্কর নির্যাতনের শিকার হতে হয়।
“আমার একটি নখ উপড়ে ফেলে তারা। তখন আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম।”
আজও তার ডান হাতের আঙুল সেই নির্যাতনের চিহ্ন বহন করছে।
রাতের পর রাত নির্যাতন
রহিম বর্ণনা করেন—প্রায় ছয় মাস ধরে প্রতিদিন রাত ৩টায় তাদের জাগিয়ে তোলা হতো, মারধর করা হতো। তখন বাংলাদেশে সকাল ৭টা। পাচারকারীরা ভিডিও কলে পরিবারকে নির্যাতনের দৃশ্য দেখাতো এবং টাকা দাবি করতো।
তার মা অনেক আগে মারা গেছেন, অসুস্থ বাবা ও ছোট দুই ভাইকে বাঁচাতে তিনি তার খালার ফোন নম্বর দেন পাচারকারীদের। “আমি চাইনি বাবা এটা দেখুক,” চোখে পানি এনে বলেন রহিম।
সাগর পাড়ির সাহস
২০২৫ সালের জুনে পাচারকারীরা তাকে ও আরও শতাধিক বাংলাদেশিকে নিয়ে যায় জুওয়ারার মরুভূমিতে। সেখান থেকে কাঠের নৌকায় চড়ে বসতে হয় ভয়াল ভূমধ্যসাগরের বুকে।
৯ জুন আন্তর্জাতিক জলসীমায় ইতালির কোস্টগার্ড গার্ডিয়া ডি ফিনাঞ্জা উদ্ধার করে ৮৯ জন অভিবাসীকে। তাদের মধ্যে ২৮ জন ছিলেন বাংলাদেশি। রহিম ছিলেন তাদের একজন। “যখন জাহাজে আমাদের তুললো, মনে হলো আমি বেঁচে ফিরেছি,” বলেন তিনি।
মায়ের ছায়া পেলেন ইতালিতে
লাম্পেদুসায় আশ্রয় দিয়েছে স্থানীয় একটি গির্জা। সেখানেই রহিম খুঁজে পেয়েছেন এক নতুন মা—৮০ বছর বয়সী সিস্টার আউসিলিয়া।
তিন বছর ধরে দ্বীপের বন্দরে কাজ করা এই নারী অভিবাসীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। রহিম বলেন,
“তিনি আমার মা।”
একটি পোস্টকার্ডে ইতালিয়ান ভাষায় লিখেছেন রহিম—
“আউসিলিয়া ই ব্রাভা, তি আমো”
(অর্থ: আউসিলিয়া খুব ভালো, আমি তোমাকে ভালোবাসি)।
আজ লাম্পেদুসায় এক মাসের বেশি সময় কাটিয়েছেন রহিম। ভাঙা শরীর, ক্ষতবিক্ষত মন নিয়েও তার চোখে এখন নতুন স্বপ্ন।
“আমি পড়াশোনা করতে চাই, তারপর কাজ খুঁজব। আমি চাই আমার বাবা ও ভাইদের শান্তিতে রাখতে।”