আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে তিনি এই ঘোষণা দেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনসংক্রান্ত চলমান কার্যক্রম পর্যালোচনা করে আমি আজ দেশবাসীর কাছে ঘোষণা করছি যে আগামী জাতীয় নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধের যেকোনো একটি দিনে অনুষ্ঠিত হবে।” তিনি আরও জানান, নির্বাচন কমিশন শিগগিরই নির্বাচনের বিস্তারিত রোডম্যাপ প্রকাশ করবে।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার এবং সংস্কার কার্যক্রমে রমজান মাসের ঈদের আগেই একটি গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব হবে বলে তিনি আশাবাদী। তিনি উল্লেখ করেন, বিশেষ করে জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের শহীদদের প্রতি সম্মান জানিয়ে বিচার কার্যক্রমে দৃশ্যমান অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাবে।
ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনকে সংকটের মূল কারণ হিসেবে দায়ী
স্বাধীনতার পর থেকে দেশের নানা সংকটের মূল কারণ হিসেবে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনকে দায়ী করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, “ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে একটি রাজনৈতিক দল বর্বর ফ্যাসিস্টে পরিণত হয়েছিল। এ ধরনের নির্বাচন যারা আয়োজন করে, তারা জাতির কাছে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত।”
প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে জোর
তিনি বলেন, একটি উৎসবমুখর, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার অত্যাবশ্যক। নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুশাসন নিশ্চিত করা না গেলে ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগ বৃথা যাবে বলে হুঁশিয়ার করেন তিনি।
‘জুলাই সনদ’ আসছে
প্রধান উপদেষ্টা আশা প্রকাশ করেন, আগামী জুলাই মাসেই সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি ‘জুলাই সনদ’ জাতির সামনে উপস্থাপন করা হবে। এটি হবে একটি প্রতিশ্রুতির দলিল, যেখানে বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাবের বাস্তবায়নের অঙ্গীকার থাকবে।
রাখাইন করিডর নিয়ে অপপ্রচারের প্রতিবাদ
সম্প্রতি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বাংলাদেশের করিডর দেওয়ার গুজবকে “সর্বৈব মিথ্যা” আখ্যা দেন ইউনূস। তিনি বলেন, “এটা চিলে কান নিয়ে যাওয়ার গল্প। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচারকারীরা অশান্তি সৃষ্টিতে ব্যস্ত।”
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা
তিনি জানান, রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় মিয়ানমারের সরকার ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে এবং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলোচনা করে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।
গুমের ঘটনা তদন্তে অগ্রগতি
গুম সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, গুম তদন্তে একটি স্বাধীন কমিশন কাজ করছে। ইতিমধ্যেই ঢাকাসহ কয়েকটি জেলায় গুমকেন্দ্র পরিদর্শন ও গণশুনানি সম্পন্ন হয়েছে।
বিচারপ্রক্রিয়ায় নতুন মাত্রা
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো বিচারপর্ব সরাসরি বা রেকর্ডকৃতভাবে গণমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে, যা মানুষের আস্থা বাড়াবে। তিনি জানান, গোপন দলিল নষ্ট করার চেষ্টা ব্যর্থ করে তদন্তকারীরা ডিজিটাল তথ্য উদ্ধার ও সংরক্ষণের কাজ করছেন।
অর্থনীতিতে বিদেশি বিনিয়োগ
প্রধান উপদেষ্টা জানান, গত ছয় মাসে বাংলাদেশে নেট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ৭৫৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ইতোমধ্যেই ১৮টি সংস্কার বাস্তবায়ন হয়েছে এবং আরও ৩০টি কাজ অগ্রাধিকার পেয়েছে। চীন, কাতার, জাপানের সঙ্গে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর ও আঞ্চলিক অর্থনীতি
চট্টগ্রাম বন্দরের আধুনিকায়নের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “এই হৃৎপিণ্ডকে বড় ও শক্তিশালী করতে হলে বিশ্বমানের ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।” তিনি বলেন, উন্নত বন্দর ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশকে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক নেতৃত্বে এগিয়ে নেবে।
পতিত ফ্যাসিবাদের অপপ্রচার রোধে একতা দরকার
ভাষণের শেষদিকে ইউনূস বলেন, “দেশ এখন যুদ্ধাবস্থায়। আমাদের একতাবদ্ধ থাকতে হবে। পতিত ফ্যাসিবাদ ও তাদের দোসরেরা আমাদের অগ্রযাত্রা থামাতে মরিয়া।” তিনি জনগণকে ঈদের শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ জানিয়ে ভাষণ শেষ করেন।